রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৩

একজন নিঃসন্তান ব্যাক্তির ঈদ

একজন নিঃসন্তান ব্যাক্তির ঈদ

ঈদ-ঊল-ফিতর ২০১৩, আগষ্ট শুক্রবার এবারের ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ীতে ছিলাম নামাজ শেষে ঈদগাহ মাঠে থেকে বাড়ীতে ফেরার পথে এক বাল্যবন্ধুর সাথে দেখা দেখা প্রায় প্রতি বছরই হয়, কুশল বিনিময়ও হয় বলতে গেলে বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাস্তার পাশেই ওদের বাড়ী তাই দেখা সাক্ষাৎ, যোগাযোগটা প্রায়ই হয় কিন্তু এবারের সাক্ষাতটা একটু ভিন্ন তাই বিষয়টা সবার সাথে, বিশেষ করে আমার মতো যারা নিঃসন্তান তাদের সাথে শেয়ার করতে চাই

ঘটনাটি সামান্যই কিন্তু তার প্রভাবে ঈদের ছুটির কয়েকটা দিন আমার মনটা যে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত ছিল তাই বিষয়টি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমি শুধু ওকে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘কি রে কেমন আছিস?’ আমার হাতটা ধরে বলল, ভালই আছি তবে ওর বলার ধরণ দেখে মনে হলো ওর মন খারাপ আমি বললাম, তোর মন খারাপ কেন? বলল, আর বলিস না কি করি, কোথায় যাই, কিছুই আর ভালো লাগেনা আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে হলো না নিজেই কথা বলতে লাগলো ছেলে-মেয়ে নাই বলে কেউ শান্তিতে থাকতে দেয় না সব জায়গায় কথা শুনতে হয় বাড়ীর লোকেদের কথা! পাড়ার লোকের কথা! হাটে বাজারে মাঠে যেখানেই যাই নানান ধরনের কথা! কেউ বলে, পোলাপান নাই, তোমার কামাই রোজগার কে খাবে? গ্রামের ভাবীরা ইয়ার্কি করে পুরুষত্ব নিয়ে মজা করে বাপে জমির ভাগ থেকে বঞ্চিত করেছে বলেছে, তোর ছেলে-মেয়ে নাই তুই জমি দিয়া কি করবি? বাড়ীর লোকের চেয়ে পাড়ার লোকের কথার জ্বালায় শেষে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় গার্মেন্টসে গেছি দুজনে যা আয় করি তা দিয়ে দুজনের খাওয়া-পরা চলে যায় তবু লোকের কথা এড়াতে তো পারি না সহকর্মীরাও কেউ কেউ বলে, ভাই, আপনার খাবার লোক নাই; এতো কাজ করেন কার জন্য? গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া পাকা রাস্তার এক পাশে দাড়িয়ে কথা বলছিলাম আমরা দুই বন্ধু স্বল্পশিক্ষিত আমার এই বন্ধুটি কথা বলতে বলতে আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলল আমি ক্ষণকালের জন্য হতবাক হয়ে গেলাম বুঝলাম এই কান্না যতোটা না নিজে নিঃসন্তান হবার জন্যে তার চেয়ে বেশী লোকের কথার জ্বালায় মানুষ কেন যে এতোটা পরচর্চা করে! নিমেষেই মনে করলাম, বন্ধুটির জন্য আমার কিছু করার আছে আপাতত কথা বলা, মনোবল বাড়িয়ে দেয়াই আমার দায়িত্ব মনে করলাম

রাস্তার পাশে একটি মুদি দোকানের সামনের মাচার উপর বসে ওর সাথে কথা বলতে শুরু করলাম আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, দোস্ত তোর কি মনে হয় সব পিতা-মাতাই খুব সুখি? তাছাড়া জীবনের সুখ ছাড়াও আছে মরনের পরের হিসাব আমরা জানি নিঃসন্তান দম্পতি অথবা পিতা-মাতা যে কেউই মৃত্যুর আগে যা যা ভালো কাজ করবে তাই তার আখেরাতে কাজে লাগবে সে হিসেবে যে কোন পিতা-মাতার চেয়ে নিঃসন্তান দম্পতিরা বেশী ভালো কাজ করার সুযোগ পায় জীবনে দান খয়রাতও বেশী করার সুযোগ পায় তিনটি এবাদত মানুষের মৃত্যুর পরও জারী থাকে জ্ঞান দান, সম্পদ দান (জন কল্যাণে স্থায়ী দান) নেক সন্তানের কর্মফল যদি আমরা তিনটি বিষয়ে ১০০ নম্বর করে ধরি, তাহলে আমরা অধীকাংশ ক্ষেত্রে নিম্নরুপ ফলাফল পাবোঃ যে কোন ব্যক্তি (নিঃসন্তান অথবা পিতা-মাতা নির্বিশেষে) প্রথমটিতে (জ্ঞান দান) একই রুপ নম্বর পাবার সম্ভাবনা বহন করে ধরি পূর্ণমাণ ১০০ করে দ্বিতীয় বিষয়ে (সম্পদ দান) অবশ্যই নিঃসন্তান ব্যক্তি যে কোন পিতা-মাতার চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে ধরি ৩০% এবং ৭০% আর তৃতীয়টিতে অধীকাংশ ক্ষেত্রেই পিতা-মাতার নম্বর নেগেটিভ হবে যেখানে নিঃসন্তান দম্পতিরা সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থানে সুতরাং নিরপেক্ষ বিবেচনায় নিঃসন্তান দম্পতিরা আখেরাতে আল্লাহর সবচেয়ে বেশী করুনা প্রাপ্ত হবে ইনশাআল্লাহ আর প্রত্যেক মানুষই একটি শরীরের মধ্যে বেঁচে থাকে তাই নিজে সুস্থ থাকাটাই জরুরী ভালোভাবে বেঁচে থাকলে যেমন নিজের জন্য কিছু করা সম্ভব তেমনি অপরের জন্যেও কিছু করা সম্ভব আমি আমার বন্ধুকে শান্তনা ভালোভাবে বেচে থাকার জন্য অনুপ্রেরণা দিচ্ছিলাম এমন সময় প্রতিবেশী একটি ছেলে একটি শিশুকে কোলে করে নিয়ে আমাদের কাছে এলো আমার বন্ধুটি শিশুটিকে কোলে নিয়ে আদর-যত্ন করলো এবং শিশুটির সাথে কথা বলতে লাগলো কিছুক্ষণ পরে ছেলেটি শিশুটিকে ফেরত নিল এবং চলে যেতে উদ্যত হলো এমন সময় বন্ধুটি খেয়াল করলো যে শিশুটি কাদা মাখা ছিল এবং বন্ধুটির ঈদের দিনের নতুন পাঞ্জাবীটি কাদায় মেখে গেছে বন্ধুটি ছেলেটিকে বলল, কিরে তুই খেয়াল করিস নাই, ওর গায়ে যে কাদা ছিল ছেলেটি তখন জবাব দিল, নেও নেও, তাও যদি ওর কাদা মেখে তোমার একটা বাচ্চাকাচ্চা হয় বলে ছেলেটি অবলিলায় চলে গেলো আমি হতাবক হয়ে চেয়ে দেখলাম আর চিন্তা করলাম, এই সমাজে একজন নিঃসন্তান মানুষকে সবার অগোচরে কতই না কথা শুনতে হয় কি সাবলিলভাবে একজন আরএকজনের আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলতে পারে অথচ এর কোন কিছুর জন্যই সে দায়ী নয় আল্লাহ যাকে খুশি পূত্র সন্তান দান করেন, যাকে খুসি কন্যা সন্তান দান করেন, যাকে খুশি উভয়টি দান করেন আর যাকে খুশি নিঃসন্তান রাখেন